দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ফলাফল এবং ইতিহাস:

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ফলাফল এবং ইতিহাস:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভুমিকাঃ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব ইতিহাসে সংঘটিত সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এটি ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছর ধরে চললেও, এশিয়ায় ১৯৩৯ সালের পূর্ববর্তী কয়েকটি সংঘর্ষকেও এর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই যুদ্ধে বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলো এবং অধিকাংশ দেশ দুই বিপরীত সামরিক জোটে বিভক্ত হয়ে লড়াই করে: মিত্রশক্তি অক্ষশক্তি।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল ইতিহাসের সর্ববৃহৎ যুদ্ধ, যেখানে প্রায় ৩০টি দেশের ১০ কোটিরও বেশি সামরিক সদস্য অংশগ্রহণ করে। এই যুদ্ধে সামরিক বেসামরিক উভয় সম্পদের পার্থক্য মুছে যায়, এবং রাষ্ট্রগুলো তাদের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক প্রযুক্তিগত সমস্ত শক্তি যুদ্ধে নিয়োজিত করে। যুদ্ধের সময় চালানো গণহত্যা, বিশেষ করে হলোকস্ট, এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কারণে এই যুদ্ধকে মানব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস অধ্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে প্রায় কোটি থেকে সাড়ে কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।

জাপান পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৩৭ সালে চীনে আক্রমণ চালায়। পরে, ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ফ্রান্স যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই ঘটনাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ধরা হয়।

১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে জার্মানি ইতালির সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলে এবং ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে। একই সময়ে, মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির মাধ্যমে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড এবং বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে। যুক্তরাজ্য এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো এই সময় একাই অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রণাঙ্গনের সূচনা হয়। একই বছরের ডিসেম্বরে, জাপান পার্ল হারবারে আক্রমণ চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে নিয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তিতে যোগদান এবং চীনের মিত্রপক্ষে অন্তর্ভুক্তি যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করে।

১৯৪৫ সালে জার্মানি এবং জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলে যুদ্ধ শেষ হয়। এই সময়ে, পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহ প্রয়োগ এবং অন্যান্য ধ্বংসাত্মক প্রযুক্তির উদ্ভাবন দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়: পশ্চিম ইউরোপ সোভিয়েত-অধিভুক্ত পূর্ব ইউরোপ। এর ফলশ্রুতিতে ন্যাটো ওয়ারশ প্যাক্ট গঠিত হয় এবং স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা ঘটে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুধু একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়, বরং এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক পরিবর্তনের একটি যুগান্তকারী অধ্যায়।

যুদ্ধের কারণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে নানা বিতর্ক থাকলেও বেশ কিছু সাধারণ ধারণা রয়েছে যা বহুলভাবে গ্রহণযোগ্য। প্রধানত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতি, মিত্রশক্তির তোষণ নীতি, এবং জার্মানি জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষার মিশ্রণেই এই যুদ্ধের সূচনা ঘটে।

. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ভার্সাই চুক্তি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯১৯ সালের ভার্সাই চুক্তি জার্মানির জন্য অত্যন্ত অপমানজনক শোষণমূলক ছিল। এই চুক্তির শর্তে জার্মানিকে তার বিশাল অংশের ভূখণ্ড, সামরিক শক্তি এবং অর্থনৈতিক সম্পদ হারাতে হয়। পাশাপাশি, যুদ্ধের জন্য জার্মানিকে দায়ী করে যে ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হয়, তা ছিল বিপুল। এই অবস্থার কারণে জার্মানির মধ্যে জাতীয় অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং তারা এই অবমাননা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পুনরায় একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিল।

. জার্মান সাম্রাজ্যবাদ নাৎসি মতবাদ

জার্মানির নাৎসি পার্টি, অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে, দেশকে পুনর্গঠন এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা পূর্ব ইউরোপের, বিশেষ করে পোল্যান্ড ইউক্রেনের, সম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোর দখল নিতে চেয়েছিল। হিটলারের ধারণা ছিল যে "জীবনযাপনের জন্য জায়গা" (Lebensraum) নিশ্চিত করতে পূর্ব দিকে প্রসারিত হওয়া জরুরি। ছাড়া ভার্সাই চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে জার্মানিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যও ছিল তাদের।


. জাপানের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা

জাপান ইতোমধ্যেই পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছিল। তারা চীনে আক্রমণ চালিয়ে এবং মাঞ্চুরিয়া দখল করে নিজেদের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে মনোযোগ দেয়। এই আক্রমণ পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের পথ প্রশস্ত করে।

. মিত্রশক্তির তোষণ নীতি

মিত্রশক্তি, বিশেষত যুক্তরাজ্য ফ্রান্স, জার্মানির আক্রমণাত্মক নীতিকে প্রথম দিকে প্রতিরোধ করার পরিবর্তে তোষণ নীতি অনুসরণ করে। তারা মনে করেছিল, হিটলারের আঞ্চলিক দাবিগুলো পূরণ করলে বড় ধরনের যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হবে। কিন্তু এই নীতি হিটলারকে আরও সাহসী করে তোলে এবং তাকে পোল্যান্ড আক্রমণসহ অন্যান্য আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ দেয়।

. আন্তর্জাতিক রাজনীতির দুর্বলতা জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে গঠিত জাতিপুঞ্জ (League of Nations) বিশ্ব শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ হয়। আক্রমণকারী দেশগুলোকে দমন করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তারা আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। এর ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা বাড়ে।

. জাতীয় অসম্মান প্রতিশোধস্পৃহা

জার্মানি তার নাগরিকরা মনে করত যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে। এই জাতীয় অসম্মান এবং প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানির আক্রমণাত্মক নীতিকে আরও উস্কে দেয়।

সংক্ষেপে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অসমাপ্ত প্রতিক্রিয়া, জার্মানি জাপানের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা, এবং মিত্রশক্তির তোষণ নীতির মতো আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ব্যর্থতা। এই সব কারণ মিলেই বিশ্ব আরও একবার এক বিধ্বংসী যুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়।

পোল্যান্ড যুদ্ধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা

পোল্যান্ড যুদ্ধের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর, জার্মানির নাৎসি বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এর আগে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জার্মানি মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি করে, যা মূলত দুই দেশের মধ্যে একটি অনাক্রমণ চুক্তি হলেও এতে পোল্যান্ড ভাগাভাগির গোপন শর্ত ছিল। অপরদিকে, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স পোল্যান্ডের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে তাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়।

যুদ্ধের সূচনা

জার্মানির ঝটিকা যুদ্ধনীতির (Blitzkrieg) প্রয়োগের মাধ্যমে প্রথম দিনেই পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করা হয়। জার্মান ট্যাংক এবং মোটোরাইজড ডিভিশনের দ্রুত অগ্রযাত্রা পোলিশ সেনাদের ছত্রভঙ্গ করে। সময় ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও তারা পোল্যান্ডকে কার্যকর কোনো সামরিক সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়। এই ঘটনাকে পশ্চিমা মিত্রশক্তির "বিশ্বাসঘাতকতা" বলে মনে করা হয়।

সোভিয়েত বাহিনীর হস্তক্ষেপ

১৭ সেপ্টেম্বর, সোভিয়েত বাহিনী পূর্ব দিক থেকে পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এটি মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির গোপন শর্ত অনুযায়ী সংঘটিত হয়। দুই দিক থেকে আক্রমণের মুখে পোল্যান্ডের সেনাবাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা হারায়।

পোল্যান্ডের পতন

  • ২৭ সেপ্টেম্বর: পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারস জার্মান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
  • অক্টোবর: পোল্যান্ডের শেষ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি কক দুর্গ পতন ঘটে।

পরিণতি

পোল্যান্ডের পরাজয়ের পর দেশটি জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। জার্মানি পশ্চিম পোল্যান্ড দখল করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব অঞ্চল অধিগ্রহণ করে। পোল্যান্ড যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, যা পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী এক বিধ্বংসী সংঘর্ষে রূপ নেয়।

 সোভিয়েত-ফিন শীতকালীন যুদ্ধ (Winter War) শুরু হয় ১৯৩৯ সালের ৩০ নভেম্বর, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ডের ওপর আক্রমণ চালায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে সংঘটিত এই যুদ্ধের মূল কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। সোভিয়েত ইউনিয়ন দাবি করে যে তাদের পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে ফিনল্যান্ডের ভূখণ্ডের কিছু অংশ প্রয়োজন। ফিনল্যান্ড এই দাবি প্রত্যাখ্যান করায়, সোভিয়েত বাহিনী পূর্ণমাত্রায় সামরিক অভিযান চালায়।

যুদ্ধের সময় ফিনিশ সেনারা সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়। তবে সংখ্যায় কম এবং সরঞ্জামে দুর্বল হলেও ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষা কৌশল সোভিয়েত বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে প্রাথমিক পর্যায়ে বাধাগ্রস্ত করে। যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ মস্কো চুক্তির মাধ্যমে, যেখানে ফিনল্যান্ড তাদের কিছু ভূখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তবুও, এই যুদ্ধে ফিনিশদের প্রতিরোধ শক্তি এবং সাহসিকতা আন্তর্জাতিক মহলে তাদের সুনাম বৃদ্ধি করে।

যুদ্ধের প্রাথমিক ধাপ

ফিনল্যান্ডের সামরিক শক্তি ছিল সীমিত, তবে তাদের দেশ রক্ষার ইচ্ছা ছিল প্রবল। স্তালিন দ্রুত বিজয়ের জন্য ঝটিকা যুদ্ধ (Blitzkrieg) কৌশল প্রয়োগের চেষ্টা করেন, কিন্তু প্রতিটি ফ্রন্টে ফিনিশ বাহিনীর দৃঢ় প্রতিরোধের মুখে পড়েন। সোভিয়েত বাহিনীর প্রথম দফার আক্রমণ ব্যর্থ হলে, ১৯৩৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নকে জাতিপুঞ্জ (League of Nations) থেকে বহিষ্কার করা হয়।

সোভিয়েত বাহিনীর পুনরায় আক্রমণ

১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত বাহিনী পুনরায় বড় আকারে আক্রমণ শুরু করে। ট্যাঙ্ক, বিমান, এবং স্লেজবাহিত সেনাবাহিনী একত্রিতভাবে ফিনিশ প্রতিরক্ষা ভেঙে দিতে চেষ্টা চালায়। অবশেষে, ১৫ ফেব্রুয়ারি ফিনিশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় একটি দুর্বলতা তৈরি হয়, যা সোভিয়েত বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

যুদ্ধের সমাপ্তি

১৯৪০ সালের মার্চ ফিনল্যান্ড শান্তির জন্য আবেদন জানায়। মস্কো চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়, যেখানে ফিনল্যান্ড তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হলেও লেনিনগ্রাদের (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) আশপাশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে তুলে দিতে হয়।

ক্ষয়ক্ষতি প্রভাব

  • ফিনল্যান্ডের লাখ সৈন্যের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার প্রাণ হারায়।
  • সোভিয়েত বাহিনী এই যুদ্ধ থেকে মূল্যবান সামরিক শিক্ষা লাভ করে, যা পরবর্তী সময়ে তাদের সামরিক দক্ষতা বাড়ায়।
  • অন্যদিকে, যুদ্ধের সময় সোভিয়েত বাহিনীর শুরুর ব্যর্থতা হিটলারের মনে তাদের সামরিক শক্তি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে। এই ভুল ধারণা পরবর্তীতে জার্মানির সোভিয়েত আক্রমণ (অপারেশন বারবারোসা) পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

শীতকালীন যুদ্ধ ফিনল্যান্ডের সাহসী প্রতিরোধের উদাহরণ হলেও, এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক কৌশলের এক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। 

নরওয়ে ডেনমার্ক: জার্মানির আগ্রাসন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নরওয়ে তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সুইডেনের কিরুনা খনি থেকে লোহা উত্তোলন করা হতো, যা শীতকালে নরওয়ের বরফমুক্ত নারভিক বন্দর এবং রেলপথের মাধ্যমে জার্মানিতে পৌঁছাত। এই সরবরাহ জার্মানির শিল্প সামরিক কার্যক্রমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আগ্রাসনের পরিকল্পনা

প্রথমে হিটলার নরওয়েকে নিরপেক্ষ রাখতে চেয়েছিলেন। তবে মিত্রপক্ষ নারভিক বন্দরের কাছাকাছি সমুদ্রে মাইন স্থাপনের পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার খবর ফাঁস হয়ে গেলে হিটলার ফ্রান্স আক্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত রেখে নরওয়ে অভিযানের আদেশ দেন। ১৯৪০ সালের এপ্রিল, জার্মানি একই সঙ্গে নরওয়ে ডেনমার্কে আক্রমণ শুরু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল সুইডেনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নিশ্চিত করা এবং লোহা সরবরাহের পথ নিয়ন্ত্রণে রাখা।

অভিযান এবং প্রতিরোধ

জার্মান বাহিনী নারভিকসহ নরওয়ের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলি দ্রুত দখল করে। বিমানবন্দরগুলোতে প্যারাশুট বাহিনী নেমে সেগুলো দখলে নিয়ে শহরগুলোতে অতর্কিত প্রবেশ করে।

  • ডেনমার্ক: বিনা বাধায় আত্মসমর্পণ করে।
  • নরওয়ে: দেশটির সেনাবাহিনী প্রতিরোধ চালায়। ১৪ এপ্রিল মিত্রপক্ষের বাহিনী নরওয়েতে অবতরণ করে এবং জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।

মিত্রপক্ষের পিছু হটা

নারভিক অঞ্চলে জার্মান বাহিনী ২৭ মে পর্যন্ত পাঁচগুণ শক্তিশালী মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। তবে ফ্রান্সে যুদ্ধ পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাওয়ায় মিত্রপক্ষ নরওয়ে থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে। এর ফলে নরওয়ের বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং রাজা সপ্তম হাকোন ব্রিটেনে আশ্রয় নেন।

জার্মানির জন্য কৌশলগত সুবিধা

জার্মানির জন্য নরওয়ে আর্কটিক সাগর এবং ব্রিটেনের কাছাকাছি একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌ বিমান ঘাঁটি হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এই দখল কৌশলগতভাবে জার্মানির সামরিক সক্ষমতাকে শক্তিশালী করেছিল এবং উত্তর ইউরোপে তাদের আধিপত্য নিশ্চিত করে।

 

ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, এবং লুক্সেমবার্গ

১৯৪০ সালের ১০ মে, জার্মানি একসঙ্গে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড এবং লুক্সেমবার্গ আক্রমণ করে।

আক্রমণের পরিকল্পনা অগ্রগতি

  • ম্যাজিনো লাইনের বিভ্রান্তি: ফরাসিরা ধারণা করেছিল, আক্রমণ তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ম্যাজিনো লাইনের ওপর অথবা বেলজিয়ামের আরদেন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আসবে। তারা মনে করেছিল, আরদেনের ঘন জঙ্গল জার্মান প্যানজার বাহিনীর অগ্রগতিকে রোধ করবে।
  • নেদারল্যান্ডের পতন: ১৪ মে নেদারল্যান্ড আত্মসমর্পণ করে।
  • আরদেন থেকে আক্রমণ: জার্মান বাহিনী আরদেন জঙ্গল ভেদ করে বেরিয়ে আসে এবং মিত্র বাহিনীর প্রতিরক্ষা ভেঙে দেয়।

ডানকার্ক থেকে পশ্চাদপসরণ

জার্মান বাহিনীর দ্রুত অগ্রগতির ফলে মিত্রবাহিনীকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়।

  • ডানকার্ক অপসারণ: ২৬ মে থেকে জুন পর্যন্ত, ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ সেনা উদ্ধার অভিযান পরিচালিত হয়। প্রায় সব যন্ত্রপাতি ফেলে রেখে মিত্র বাহিনী সৈন্যদের উদ্ধার করে।
  • বেলজিয়ামের পতন: ২৭ মে, বেলজিয়াম আত্মসমর্পণ করে।

ফ্রান্সের পরাজয়

  • ইতালির যোগদান: ১০ জুন ইতালি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ২০ জুন আক্রমণ শুরু করে।
  • প্যারিসের পতন: ১৪ জুন জার্মান বাহিনী প্যারিস দখল করে।
  • শান্তিচুক্তি: ২২ জুন জার্মানি এবং ফ্রান্সের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফ্রান্সের বেশিরভাগ অংশ জার্মানির দখলে চলে যায়।

ভিশি ফ্রান্স

ফ্রান্সের অবশিষ্ট অংশে, ফিলিপ পেঁত্যাঁ একটি জার্মান-নিয়ন্ত্রিত নিরপেক্ষ সরকার গঠন করেন। এই সরকার ভিশি ফ্রান্স নামে পরিচিত হয়।

রোমানিয়ার তেলের জন্য হিটলারের পরিকল্পনা

সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে হিটলারের জন্য রোমানিয়ার প্লোইস্তি তেলক্ষেত্র ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • ১৯৪০ সালে চুক্তি: জার্মানি রোমানিয়ার মধ্যে তেল অস্ত্র চুক্তি হয়।
  • রোমানিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকট: হাঙ্গেরি রোমানিয়ার বিরোধে জার্মানি মধ্যস্থতা করে, যা রোমানিয়ার জনগণের ক্ষোভ বাড়ায়। রাজা দ্বিতীয় ক্যারল মুকুট ছেড়ে দেন এবং সেনাপ্রধান আন্তনেস্কু জার্মান সেনা ডাকেন।
  • জার্মান উপস্থিতি: ১২ অক্টোবর ১৯৪০, বুখারেস্টে জার্মান সৈন্য অবতরণ করে।

গ্রিস আক্রমণ এবং মুসোলিনির ব্যর্থতা

মুসোলিনি, জার্মান কূটনীতির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে, ২৮ অক্টোবর ১৯৪০ আলবেনিয়া থেকে গ্রিস আক্রমণ করেন।

  • গ্রিক প্রতিরোধ: গ্রিকরা আক্রমণ প্রতিহত করে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে আলবেনিয়ার এক-তৃতীয়াংশ দখল করে।
  • মিত্রশক্তির উপস্থিতি: ক্রিটে ব্রিটিশ সৈন্য মোতায়েন হয়, আর তুরস্ক সৈন্য সমাবেশ করে।

বলকানে জার্মানির অভিযানের প্রস্তুতি

  • অক্ষশক্তির সম্প্রসারণ: হিটলার হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, এবং স্লোভাকিয়াকে অক্ষশক্তিতে যোগ দেয়।
  • বুলগেরিয়ায় সৈন্য: মার্চ ১৯৪১, বুলগেরিয়ায় জার্মান বাহিনী প্রবেশ করে।
  • যুগোস্লাভ সংকট: যুবরাজ পল অক্ষশক্তিতে যোগ দিলেও, ২৭ মার্চ একটি অভ্যুত্থানে রাজা দ্বিতীয় পিটার ক্ষমতায় আসেন।

বলকান যুদ্ধ

এপ্রিল ১৯৪১, জার্মানি যুগোস্লাভিয়া এবং গ্রিসে আক্রমণ চালায়।

  • আত্মসমর্পণ: ১৭ এপ্রিল যুগোস্লাভিয়া এবং ২২ এপ্রিল গ্রিস আত্মসমর্পণ করে।
  • ক্রিট দখল: মে মাসে ক্রিটে জার্মান ছত্রীসেনা অবতরণ করে।

বলকানের প্রতিরোধ

যুগোস্লাভিয়ায় প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে ওঠে।

  • প্রতিরোধ দল: দ্রজা হিমাজলোভিচের নেতৃত্বে সেন্টিক দল এবং জোসেফ টিটোর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট গেরিলা দল যুদ্ধ চালিয়ে যায়।

উত্তর আফ্রিকা ভূমধ্যসাগরীয় অভিযান

ইতালির আক্রমণ

১৯৪০ সালের জুনে ইতালিয়ান বাহিনী মাল্টা ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ডে আক্রমণ চালায় এবং মিশরে প্রবেশ করে। তবে এই আক্রমণ বড় কোনো সাফল্য আনতে পারেনি।

  • মাল্টা সোমালিল্যান্ড: ইতালির অগ্রগতি ব্রিটিশ পাল্টা আক্রমণে বাধাগ্রস্ত হয়।
  • ব্যর্থ অভিযান: অক্টোবরে গ্রীসে আক্রমণে ইতালির প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।

জার্মানির হস্তক্ষেপ

ইতালির পরাজয়ের পর হিটলার বলকান উত্তর আফ্রিকায় সামরিক শক্তি পাঠায়।

  • আফ্রিকা কর্পস: মার্চ ১৯৪১- মার্শাল রোমেলের নেতৃত্বে জার্মান বাহিনী ব্রিটিশ কমনওয়েলথ বাহিনীকে মিশর পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য করে।

বলকানে অক্ষশক্তির বিজয়

এপ্রিল ১৯৪১, যুগোস্লাভিয়া গ্রিসে জার্মান আক্রমণ শুরু হয়।

  • দ্রুত বিজয়: দুই দেশই এক মাসের মধ্যে আত্মসমর্পণ করে।
  • প্রতিরোধ যুদ্ধ: জার্মান দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে ওঠে।

ভূমধ্যসাগরীয় অভিযান এবং মিত্রশক্তির পাল্টা আক্রমণ

সিরিয়া লেবাননে মিত্রশক্তি

১৯৪১ সালে ব্রিটিশ মুক্ত ফরাসি বাহিনী সিরিয়া এবং লেবাননে অভিযান চালিয়ে অঞ্চলটি দখল করে।

ইরাকে অভ্যুত্থান দমন

কমনওয়েলথ বাহিনী জার্মান-সমর্থিত ইরাকি অভ্যুত্থান দমন করে।

বলকান উত্তর আফ্রিকায় জার্মানির সাফল্য সত্ত্বেও, প্রতিরোধ পাল্টা আক্রমণগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কৌশলগত ভারসাম্যে বড় ভূমিকা রাখে।

প্রধান নিবন্ধসমূহ

শরণার্থী সমস্যা

মূল নিবন্ধ: শরণার্থী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অগণিত মানুষ শরণার্থী হয়ে পড়ে।

  • শরণার্থীদের সংখ্যা: যুদ্ধ শেষে শুধু ইউরোপেই কোটিরও বেশি মানুষ শরণার্থী হয়েছিল।
  • জাতিসংঘের ভূমিকা: ১৯৪৩ সালে মিত্রশক্তি জাতিসংঘ ত্রাণ পুনর্বাসন প্রশাসন (ইউএনআরআরএ) গঠন করে। এই সংস্থা ইউরোপ চীনে শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং সহায়তার কাজ করেছিল।
    • সংস্থার উদ্যোগে মিলিয়ন শরণার্থী তাদের নিজ বাসভূমিতে ফিরে যায়।
    • প্রায় মিলিয়ন শরণার্থী মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।

জার্মান শরণার্থীদের দুর্ভোগ

  • পূর্বাঞ্চল থেকে বিতাড়ন: যুদ্ধের শেষ দিকে রেড আর্মির আক্রমণ থেকে বাঁচতে পূর্ব প্রুশিয়া, পোমারানিয়া এবং সিলেসিয়া থেকে মিলিয়ন জার্মান বেসামরিক নাগরিক উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিম জার্মানির ম্যাকলেনবার্গ, ব্রান্ডেনবার্গ এবং স্যাক্সনি অঞ্চলে আশ্রয় নেয়।
  • পটসড্যাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত:
    • পটসড্যামে মিত্রশক্তি অনুমোদন না করায় যুগোস্লাভিয়া এবং রোমানিয়ায় বসবাসরত হাজার হাজার জাতিগত জার্মানদের সোভিয়েত ইউনিয়নে দাসশ্রমে পাঠানো হয়।
    • ইতিহাসের বৃহত্তম শরণার্থী স্থানান্তর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৫ মিলিয়ন জার্মান স্থানান্তরিত হয়।

মৃত্যুহার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শরণার্থী হওয়ার প্রক্রিয়ায় দুই মিলিয়নেরও বেশি জার্মান প্রাণ হারান।

শরণার্থী সমস্যা শুধু যুদ্ধের সময়েই নয়, এর পরবর্তী সময়েও বিশাল মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

নিম পাতার উপকারিতা, অপকারিতা এবং ব্যবহার বিধি।

গাজর খাওয়ার উপকারীতা, অপকারীতা এবং নিয়মাবলী।